রাজস্ব ফাঁকি, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি, ঘুষ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বেসরকারি মোবাইল কোম্পানি ‘রবি’র বিরুদ্ধে।

মোবাইল শিল্পের উন্নয়নে ব্যাপক হারে বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল রবি। তবে এখন পর্যন্ত নামমাত্র বিনিয়োগ করেছে এ মোবাইল কোম্পানিটি। শতভাগ বিদেশি মালিকানায় এ কোম্পানির বিনিয়োগ হয়েছে বাংলাদেশের অর্জিত মুনাফা থেকে। ২০০৬ সাল থেকে এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে রবি মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। বিনিয়োগ নিয়ে রবির দাবি ও বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যে রয়েছে বড় ফারাক। বিনিয়োগের নামে শুভঙ্করের ফাঁকি দিচ্ছে রবি।
২০১০ সালের ২৮ মার্চ ‘রবি’ ব্র্যান্ড হিসেবে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে রবি আজিয়াটা লিমিটেড। মালয়েশিয়াভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি আজিয়াটা গ্রুপ বারহাদ (আজিয়াটা) রবির ৭০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। এর আগে ১৯৯৭ সালে টেলিকম মালয়েশিয়া (টিএম) ইন্টারন্যাশনাল ও বাংলাদেশের এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে ‘একটেল’ নামে কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়।
২০০৮ সালের শেষের দিকে জাপানের এনটিটি ডোকোমো টিএম গ্রুপের সঙ্গে যোগ দেয়। এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানির মালিকানায় থাকা একটেলের ৩০ শতাংশ শেয়ার ৩৫ কোটি মার্কিন ডলারে কিনে নেয় ডোকোমো। টিএম গ্রুপের সঙ্গে ডোকোমো আরও ১০ কোটি ডলার ব্যয় করে। এর ফলে শতভাগ বিদেশি মালিকানায় চলে যায় একটেলের নিয়ন্ত্রণ। তবে মালিকানা হস্তান্তরের এ বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় পরিশোধ হয়নি। এর ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
রবির মালিকানা হস্তান্তরেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ২০০৮ সালে ‘এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানির’ হাতে থাকা সমুদয় শেয়ার কিনে নেয় জাপানের এনটিটি ডোকোমো। মালিকানা হস্তান্তর বাবদ একটি টাকাও সরকারি তহবিলে যায়নি মর্মে অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। রবির মালিকানা হস্তান্তর বাবদ কি পরিমাণ অর্থ পাওয়া গিয়েছিল, তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন বিটিআরসির অর্থায়ন ও হিসাব বিভাগের পরিচালক আশিষ কুমার কুণ্ডু।
২০০৬ সাল থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৬৭৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে রবি কর্তৃপক্ষ। কোম্পানির দাবি, ২০১২ সালে রবি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) হিসেবে ১ হাজার ৭৫৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা নিয়ে এসেছে।
তবে বিনিয়োগ বোর্ডের পরিসংখ্যানে রবির তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। বিনিয়োগ বোর্ড জানিয়েছে, ২০১৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১৬১ কোটি ৬০ লাখ টাকার এফডিআই এসেছে রবির মাধ্যমে।
ওই সময়ে টেলিকমিউনিকেশন খাতের পাঁচটি কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে কম এফডিআই এনেছে রবি। গ্রাহক স্বল্পতার কারণে ধুঁকতে থাকা সিটিসেল ওই সময়ে ২২৮ কোটি ২১ লাখ ৩২ হাজার টাকার এফডিআই নিয়ে এসেছে। রবির অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলালিংকের পেরেন্ট কোম্পানি ওরাসকম টেলিকম পাঠিয়েছে ৭৮৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। গ্রাহক সংখ্যায় পিছিয়ে থাকা ওয়ারিদ টেলিকম এফডিআই এনেছে ৭ হাজার ৬২৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। বৈদেশিক বিনিয়োগে শীর্ষে রয়েছে গ্রামীণফোন। নরওয়ের টেলিনর ৯ হাজার ২৭৪ কোটি ৬০ লাখ টাকার এফডিআই পাঠিয়েছে বাংলাদেশে।
রবি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত বছর কোম্পানি কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। এমনকি ২০০৬ সাল থেকেই রবি কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না শেয়ারহোল্ডারদের। ওই সময় থেকে ২ হাজার ৬৭৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে রবি। এ বিনিয়োগ এসেছে মূলত বাংলাদেশে পরিচালিত ব্যবসার লাভ থেকে।
তাছাড়া রবির বিনিয়োগের একটা বড় অংশ এসেছে ঋণ থেকে। ২০১০ সালের ১৫ জুন এক চুক্তির আওতায় রবি চীনের ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (সিডিবি) থেকে ১০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে। চুক্তির আওতায় চায়না প্রতিষ্ঠান হুয়াউই থেকে যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। এর বাইরে চীন থেকে আরও ৭ কোটি ডলার মূল্যমানের প্রযুক্তি কিনেছে রবি। সুতরাং রবির পুরো বিনিয়োগই সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের ধাঁচে করা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেও রবি বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়েছে বলে জানা গেছে। কোম্পানির ব্যাংক ঋণ সম্পর্কে জানতে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হলেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি রবি কর্তৃপক্ষ।
দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেও রবি বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়েছে বলে জানা গেছে। কোম্পানির ব্যাংক ঋণ সম্পর্কে জানতে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হলেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি রবি কর্তৃপক্ষ।
বিভিন্ন কৌশলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে রবির বিরুদ্ধে। সিম জালিয়াতির মাধ্যমে ফাঁকি দেয়া ৬৫৫ কোটি টাকার রাজস্ব সরকারি তহবিলে জমা দিতে টালবাহানা করছে রবি। নতুন গ্রাহকের কাছে সিম বিক্রি করে তাকে পুরনো গ্রাহক দেখিয়ে এ অর্থ ফাঁকি দিয়েছে রবি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিশেষ অনুসন্ধান চালিয়ে এ দুর্নীতি খুঁজে পায়। ফাঁকি দেয়া অর্থ জমা দিতে রবিকে কয়েক দফায় চিঠি দিয়ে তাগিদ দিয়েছে এনবিআর। তবে এর মধ্যে এক বছরের বেশি সময় চলে গেলেও ফাঁকি দেয়া টাকা জমা দেয়া হয়নি। রবি আজিয়াটার মাদার কোম্পানি আজিয়াটা গ্রুপের প্রতিবেদনে এনবিআরের চিঠির সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিশেষ অনুসন্ধান চালিয়ে এ দুর্নীতি খুঁজে পায়। ফাঁকি দেয়া অর্থ জমা দিতে রবিকে কয়েক দফায় চিঠি দিয়ে তাগিদ দিয়েছে এনবিআর। তবে এর মধ্যে এক বছরের বেশি সময় চলে গেলেও ফাঁকি দেয়া টাকা জমা দেয়া হয়নি। রবি আজিয়াটার মাদার কোম্পানি আজিয়াটা গ্রুপের প্রতিবেদনে এনবিআরের চিঠির সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, মোবাইল ফোনের নতুন সংযোগ কিনতে চাইলে এর জন্য ৮০০ টাকা কর বাবদ পরিশোধ করতে হয়। অপারেটরদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা থাকায় সংশ্লিষ্ট অপারেটরই এ অর্থ পরিশোধ করে। তবে সিমকার্ড হারিয়ে গেলে বা কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেলে কর ছাড়াই নতুন সিমকার্ড নিয়ে পুরনো সংযোগ চালু করা যায়। সিম রিপ্লেসমেন্টের ক্ষেত্রে প্রথম যিনি সিম কিনবেন, তিনিই শুধু সুযোগটি পাবেন। ভিন্ন গ্রাহক এ সুযোগ পাবেন না। কিন্তু রবি হারানো সিম প্রথম গ্রাহকের নামে ইস্যু না করে পরিবর্তিত গ্রাহককে একই নম্বর দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে এনবিআর। এভাবে সিম পরিবর্তনের (রিপ্লেসমেন্ট) সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রবি।
২০০৮ সালে সিম রিপ্লেসমেন্ট জালিয়াতি শুরু করে রবি। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে রবি নতুন সিম ইস্যু বা বিক্রি করে ৫৬ হাজার ১৪৩টি। একই মাসে সিম বদল হয়েছে ৯৮ হাজার ৭৯৩টি। অক্টোবরে ১৬ হাজার ৮৩টি নতুন সিম বিক্রি হলেও রিপ্লেস দেখানো হয় ১ লাখ ১৮ হাজার ৯১৫টি। ২০০৯ সালের এপ্রিলে ৭০ হাজার ৬৫৪টি নতুন সিম বিক্রির বিপরীতে রিপ্লেস হয় ২ লাখ ৪৭ হাজার ৩৯৮টি। মে মাসে ৭ হাজার ৯৪টি নতুন সিম বিক্রির পাশাপাশি বদলে দেয়া হয় ৩ লাখ ৪৯ হাজার ২০৮টি। জুনে নতুন সংযোগের সংখ্যা ১০ হাজার ৮৭৯ আর সিম বদল হয় সাড়ে ৩ লাখেরও বেশি। একই বছরের নভেম্বরে ২৭ হাজার ২২১টি নতুন সিম বিক্রির বিপরীতে রিপ্লেস করা হয় ২ লাখ ১৫ হাজার ৫৩৫টি সিম। সব মিলিয়ে এ ৬ মাসে প্রতিষ্ঠানটি নতুন সিম ইস্যু করে ১ লাখ ৮৮ হাজার ২৭৪টি। একই সময় বদলে দেয়া সিমের সংখ্যা ১৩ লাখ ৭৬ হাজার ১১৭টি। নতুন সিম বিক্রির প্রায় সাড়ে ৭ গুন সিম বদলে দেয়ার এ হারকে অবিশ্বাস্য বলে মনে করে এনবিআর।
এ বিষয়ে ২০১২ পঞ্জিকা বর্ষের শেষ প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনে আজিয়াটা বারহাদ জানিয়েছে, গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি এনবিআরের বৃহত্ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ৬৫৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা কর ফাঁকির অভিযোগে রবিকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেয়। কারণ প্রদর্শনে ব্যর্থ হলে সরকারি কোষাগারে এ অর্থ জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
কয়েক দফা চিঠি চালাচালির পর বিষয়টি আদালতে গড়ায়। হাইকোর্ট এনবিআরের নির্দেশ ২ মাসের জন্য স্থগিত করে। তবে রবিকে ১০ দিনের মধ্যে কারণ দর্শাও নোটিশের জবাব দিতে নির্দেশ দেয়। ৭ মে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ চ্যালেঞ্জ করে আপিল বিভাগে আবেদন করে এনবিআর। চেম্বার জজ হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন।
তবে স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও ফাঁকি দেয়া টাকা জমা দেয়নি রবি। পরবর্তীতে হাইকোর্টে আবেদন করে প্রথমে এক মাস এবং পরে আরও ৬ মাসের স্থগিতাদেশ নেয় রবি। আগামী ২১ এপ্রিল উচ্চ আদালতে এর শুনানি হওয়ার কথা।
এর বাইরে রবির বিরুদ্ধে প্রায় ৩০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ পাওয়া গেছে। রবি আজিয়াটার আমদানি করা শত কোটি টাকার পণ্য চালান খালাস হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের কর্মকর্তারা সম্প্রতি রবির আটক ৬টি চালান শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করেন। আমদানিকারক ও বিটিআরসির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে যৌথ ইনভেন্ট্রিতে মিথ্যা ঘোষণা এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হয় তখন। শুল্ক আইন অনুযায়ী শুল্ক গোয়েন্দা ও আমদানিকারকের শুনানির পর এসব চালান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেবেন চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার। কিন্তু এর কিছুই না করে তড়িঘড়ি করে গোপন শুল্কায়নের মাধ্যমে অভিযুক্ত চালান খালাস দেয়া হয়।
এদিকে রবি আজিয়াটার শীর্ষ পদগুলো দখল করে আছেন বিদেশিরা। কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন মাইকেল কোয়েহনার। চিফ মার্কেটিং অফিসার প্রদীপ শ্রীবাস্তব ভারতীয় নাগরিক। এছাড়া চিফ স্ট্র্যাটেজিক অফিসার এবং ডিজিটাল সার্ভিসেসের কান্ট্রিহেডের দায়িত্বও পালন করছেন দুজন বিদেশি।
রবির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে কোম্পানির প্রচার ও গণমাধ্যম বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ তালাত কামাল বলেন, বাংলাদেশের আইন মেনেই রবি ব্যবসা করছে। দেশি ব্যাংক ব্যবস্থায় রবির বড় কোনো ঋণ নেই বলে দাবি করেছেন তিনি। সিম জালিয়াতির মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ সম্পর্কে আপাতত কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন তালাত কামাল। মালিকানা হস্তান্তরে বিটিআরসির ধার্য করা ফি পরিশোধ বিষয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি। আরও সময় নিয়ে এসব বিষয়ে উত্তর দেবেন বলে জানিয়েছেন তালাত কামাল। তবে গত তিন দিনেও এ বিষয়ে রবি কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সৈয়দ মিজানুর রহমান ও জাহিদুল ইসলাম, দৈনিক আমারদেশ
Post a Comment